রমজানের গুরুত্বপূর্ন সকল কিছু
আশা করি নিম্নের লেখাগুলো পড়লে রমজানের শিক্ষা ও তাৎপর্য, মাহে রমজানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, রোজা রাখার দোয়া, রোজা ভঙ্গের কারণ, রোজা রাখার নিয়ত, রোজার গুরুত্ব, রোজার ফজিলত সম্পর্কে হাদিস, রোজার ফরজ সমূহ, রোজার সূরা, রোজা ভঙ্গের কারণ, রোজার দোয়া সহ রমজানের সকল নিয়ম কানুন গুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন।
রোজার ইতিহাস ও রোজা সম্পর্কে আলোচনা
আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসকে রোজা পালন করাকে ফরজ করে দিয়েছেন। যাদের মাঝে রোজা পালন করার শর্তাবলী থাকবে, তাদের জন্য রমজানের রোজা পালন করা ফরজ করা হয়েছে।
কারণ আল্লাহ তাআলা রমজান মাসকে বান্দাদের জন্য রহমত বরকত ও নাজাতের মাস হিসেবে গণ্য করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন- তোমাদের মধ্যে যারা এই (রমজান) মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১৮৫)।
রোজা ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টিঃ-
* মুসলিম হওয়া। (অমুসলিমদের রোজা পালন করা প্রযোজ্য নয়)।
* প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। (অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উপর রোজা ফরজ নয়)।
* জ্ঞানবান হওয়া। (অর্থাৎ মস্তিষ্ক বিকৃত/পাগল লোকের উপর রোজা ফরজ নয়)।
* নারীরা পবিত্র থাকা। (নারীদের হায়েয তথা ঋতুস্রাব এবং নিফাস (সন্তান জন্মদান পরবর্তী সময়) থেকে পবিত্র থাকা। কারণ নারীরা হাফেজ ও নিফাস চলাকালীন সময়ে অপবিত্র থাকে। আর অপবিত্র থাকা অবস্থায় রোজা রাখাযায় না। নারীদের হায়েজ ও নিফাসের কারণে যেকয়টা রোজা ভঙ্গ হবে, ওই রোজা গুলোকে পরবর্তীসময়ে আদায় করে নিতে হবে। উত্তম হলো পরবর্তীতের রমজান মাস আসার আগেই তা আদায় করে নেওয়া)।
* রোজা পালন করতে সামর্থবান হওয়া। (মুসাফির না হওয়া। কারণ মুসাফিরের জন্য রোজা ফরজ নয়)।
রমজানের রোজার তাৎপর্য কি
আরবী বৎসরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত মাস রমজানুল মুবারক। এই মাসে দিনের বেলায় রোজা রাখা ফরজ। আর রাতের বেলায় তারাবীহ আদায় করা সুন্নত। এই মাসে নফল ফরজের সমান এবং প্রতিটি ফরজ ৭০টি ফরজের সমান। এই মাসে গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় এবং মুমিনের রিযিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। রোজাদারের জন্য সমূদের মৎস পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। রোজাদারের দোয়ার প্রতি ফেরেস্তারা আমীন, আমীন বলতে থাকে।
আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হইতে বিরত থাকাকে রোজা বলে।
রোজা তিন রকমেরঃ
(১) ফরজ রোজা, (২) ওয়াজিব রোজা ও (৩) নফল রোজা।
ফরজ রোজা হইতেছে রমজানের রোজা এবং কাজা ও কাফফারার রোজা।
ওয়াজিব রোজা হইতেছে মানত রোজা।
নফল রোজা হইতেছে ফরজ ওয়াজিব ব্যতিত সমস্ত রোজা।
বৎসরে পাঁচ দিন রোজা হারাম। দুই ঈদের দুই দিন এবং কোরবানীর পরের তিন দিন।
রোজা রাখার নিয়ম
রোজার জন্য যেরুপ পানাহার, যৌনসঙ্গম, তৃপ্তিকার কাজ হতে বিরত থাকা ফরয, তদ্রুপ নিয়ত করাও ফরয। নিয়ত মুখে পড়া ফরয না, যদি মনে মনে রোজা রাখার সংকল্প পাওয়া যায়, তাতেই রোজা হয়ে যাবে। যদি মনের সংকল্পের সাথে মুখে বাংলা বা আরবীতে নিয়ত পড়ে লয়, তবে ভাল হয়।
রোজার নিয়ত
উচ্চারণঃ নাওয়াইতু আন আসুমা গাদাম মিন শাহরি রামাদ্বানাল মুবারাকি ফারদ্বাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস সামীউল আ’লীম।
অর্থঃ ইয়া আল্লাহ! আমি আগামীকাল তোমার জন্য রমযান মাসের ফরয রোজা রাখতে মনস্থ করলাম। অতএব তুমি তা কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্ব শ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।
ইতফতার করার দোয়া
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলাইকা তাওয়াককালতু ওয়া আলা রিযকিকা আফত্বারতু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রাখিয়াছি এবং তোমার দেয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করতেছি, তোমার কৃপায়, হে কৃপাময় ও করুনাময়।
রোজা ভঙ্গের কারণ
নিম্ন লিখিত কারণে রোজা ভেঙ্গে যায় এবং একটি রোযার কাযাই ওয়াজিব হয়। যথা: (ক) কোন অখাদ্য বস্তু খেয়ে ফেললে, (খ)কুলি করার সময় অনিচ্ছাকৃত পানি গলার ভিতরে ঢুকে গেলে। (গ) জোর পূর্বক কোন রোজাদারকে কেহ পানাহার করালে। (ঘ) প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তায় ঔষধ বা অন্য কোন কিছু প্রবেশ করলে। (ঙ) নিদ্রিত অবস্থায় কোন কিছু খেয়ে ফেললে (চ) বৃষ্টির পানি মুখে পড়ায় তা গিলে ফেললে। (ছ) শরীরে ঔষধ প্রবেশ করালে (জ) ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করলে অথবা পুনঃরায় তা গিলে ফেললে (ঝ) রাত্রি মনে করে সুবহে সাদিকের পর পানাহার করলে (ঞ) সন্ধ্যা মনে করে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করলে (ব) ভুলক্রমে পানাহার করলে রোজা নষ্ট হয় না, কিন্তু এরুপ করার পর রোজা বঙ্গ হয়ে গিছে মনে করে যদি কিছু খায় তবে তার রোজা অবশ্য ভঙ্গ হয়ে যাবে। (ভ) কোন স্ত্রীলোক অসতর্ক অবস্থায় ঘুমিয়েছে কিংবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এরুপ অবস্থায় কেহ তার সহিত সহবাস করলে তার রোজাভঙ্গ হয়ে যাবে। আর পুরুষের উপর কাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।
উপরের সকল অবস্থায় রোজা নষ্ট হয়ে গেলেও পানাহার করা যাবে না, বরং সমস্ত দিন রোজাদারের ন্যায় না খেয়ে থাকা ওয়াজিব।
রোজা মাকরূহ হবার কারণ
নিম্নলিখিত কারণে রোজা মাকরূহ হয় যেমন- (ক) গীবত বা পরনিন্দা করলে (খ) মিথ্যা আচরণ করলে (গ) অশ্লীল কথাবার্তা বললে (ঘ) গালি গালাজ করলে (ঙ) ঝগড়া বিবাদ করলে (চ)দেরী করে ইফতার করলে (ছ)ইফতার না করলে (জ) দাঁত হতে ক্ষুদ্র কোন বস্তু বরে করে চিবিয়ে খেলে (ঝ) গরম বোধ হওয়ায় বার বার কুলি করলে বা গায়ে ঠান্ডা কাপড় জড়ায়ে রাখলে। (ঞ) কুলি করার সময় গড়গড়া করলে।
রোজা কখন না রাখার বৈধতা রয়েছে
নিম্নলিখিত কারণে রোজা না রাখা জায়েয রয়েছে। যেমন-
(ক) যদি কেউ এরূপ দুরারোগ্য হয়ে পড়ে যে রোজা রাখলে তার রোগ বেড়ে যাবে অথবা রোগ দুরারোগ্য হয়ে উঠবে অথবা প্রাণহানি ঘটবে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়। তা হলে তার জন্য তখন রোজা না রেখে আরোগ্য লাভ করার পর কাযা রাখা দুরস্ত কিন্তু শুধু নিজের কাল্পনিক খেয়ালে রোজা ছেড়ে দেয়া জায়েয নেই। এরূপ ক্ষেত্রে কোন দ্বীনদার মুসলমান চিকিৎসকের সার্টিফিকেটই চুড়ান্ত বিবেচ্য।
(খ) রোগ আরোগ্য হওয়ার পর যে দুর্বলতা থাকে সে অবস্থায় রোজা রাখলে যদি যুনঃরায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা দেখা দেয় তবে সে অবস্থায় রোজা না রাখা জায়েয।
(গ) যারা শরীয়ত অনুসারে মুসাফির তাদের জন্য সফরে থাকাকালীন সময়ে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে।
(ঘ) গর্ভবর্তী মহিলা অথবা সদ্য প্রসুত শিশুর স্তন্যদায়িনীর রোজা রাখলে যদি নিজের বা শিশুর জীবনের আশংকা থাকে তবে তাদের জন্য রোজা না রাখা জায়েয। তারা পরে অন্য সময় কাযা রোজা রেখে নেবে।
(ঙ) স্ত্রীলোকের ঋতুস্রাব দেখা দিলে বা সন্তান প্রসব হলে সে আর তখন রোজা রাখবে না বরং পরে কাযা রাখবে।
তারাবীহ নামাজের বিবরণ
রজমান মাসের প্রথম তারিখের চাঁদ দেখা হইতে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার পূর্ব রাত্রি পর্যন্ত প্রতিদিন এশার নামাজের পরে বিতর নামাজের পূর্বে দুই রাকাত করে মোট বিশ রাকাত তারাবীহর নামাজ আদায় করতে হয়। তারাবীহর নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
তারাবীহ নামাজের নিয়ত
উচ্চারণঃ নাওয়াইতুআন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তাআ’লা রাকআ’তাই ছালাতিত তারাবীহি সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআ’লা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।
বাংলায় নিয়তঃ আমি আল্লাহর জন্য কেবলামুখী হইয়া তারাবীহর দুই রাকাত সুন্নত নামাজ আরম্ভ করিতেছি।
আল্লাহু আকবার। দুই রাকাতের পরে একবার দুরুদ শরীফ পড়িতে হয়।
চার রাকাতের পরে এই দোয়া পড়িতে হয়ঃ
উচ্চারণঃ সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা যিল ইযযাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হাইবাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল জাবারুতি, সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লায়ী লা-ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদান সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি ওয়াররুহ।
অর্থঃ আমি তাঁহারই পবিত্রতা প্রকাশ করিতেছি, যিনি বাদশাহ ও ফিরিশতাদের প্রভু ও আমি তাঁহারই পবিত্রতা প্রকাশ করিতেছি। যিনি মান-ইজ্জতের মালিক এবং যিনি ভয়, ক্ষমতা, গৌরবের মালিক। আমি তাঁহারই পবিত্রতা প্রকাশ করিতেছি, যিনি চিরঞ্জিব, যাহার ঘুম নাই, নির্দোষ ও পবিত্র, আমি তাঁহারই গুণগান করিতেছি, যে আমাদের ও ফিরিশতাগণের এবং সকল আত্মাদের প্রভু।
তারাবীহ নামাজের মুনাজাত
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযুবিকা মিনান্নার, ইয়া খালিকাল জান্নাতি ওয়ান্নারি, বিরাহমাতিকা ইয়া আযীযু, ইয়া গাফফারু ইয়া কারীমু ইয়া সাত্তারু ইয়া রাহীমু ইয়া জাব্বারু, ইয়া খালিক্কু ইয়া বাররু। আল্লাহুম্মা আজিরনা মিনান্নারি, ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীর, বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে জান্নাত চাই, তোমারই কৃপায় হে জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টিকারী, হে ক্ষমতাবান, হে ক্ষমাশীল। হে সর্ব সম্মানিত, হে দোষ গোপনকারী, হে মহব্বতকারী, হে শক্তিধর, হে সৃজনকারী, হে দয়াবান, হে আল্লাহ। আমাদের জাহান্নামের আগুন হইতে রক্ষা করুন। হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী হে দয়াময়! তোমার দয়ায় কবুল কর।
লাইলাতুল কদরের বিবরণ
রমজানের প্রতিটি রাতই ইবাদাতের জন্য সুবর্ণ সময়। তারপরও আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে এই মাসে শবে কদর নামে একটি মর্যাদাপূর্ণ বরকতময় রজনী দান করেছেন। এই রজনীতে কুরআন মজিদ অবতীর্ণ হয়। কুরআন মজিদে এই রাত্রিকে হাজার মাস অপেক্ষো উত্তম বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের নিয়তে ইবাদতে দন্ডায়মান হয় তার পিছনের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। শবে কদরের তারিখ অনির্দিষ্ট। তবে শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাতিতে শবে কদরকে তালাশ করার কথা হাদীসে বলা হয়েছে। ২৭শে রমজানকেই বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়।শবে বরাতের মত শবে কদরেও ইবাদতের কোন বিশেষ পদ্ধতি নেই। নফল ইবাদত অর্থাৎ নামাজ, জিকির, তেলাওয়াত, ইস্তেগফার, দরুদশরীফ ও দোয়ার আমল করবে।
শবে ক্বদর নামাজের নিয়ত
উচ্চারণঃ নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তাআ’লা রাকআ’তাই ছালাতিল লাইলাতিল ক্বাদরি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।
বাংলায় ন্য়িতঃ আমি আল্লাহর জন্য ক্বেবলামুখী হইয়া শবে ক্বদরের দুই রাকআত নামাজ পড়িতেছি, আল্লাহু আকবার।
শেষ কথাঃ
আশা করি রোজার নিয়ত, রোজা সম্পর্কে আলোচনা, রোজা ভঙ্গের কারণ, রোজা রাখার সময়, রমজানের রোজার তাৎপর্য কি, মাসিকের পর কখন রোজা রাখা উচিত, রমজানের গুরুত্ব ও রোজা রাখার কারণ কি এবং রমজানের গুরুত্বপূর্ন সকল কিছু এই পোষ্ট থেকে জেনে নিতে পারেছেন।
0 coment rios: